২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎকে খুন করল ঘাতক। আর ৩ মার্চ, ২০১৮-তে এসে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই ঘাতকরা অনেক আগে থেকেই তৎপর। হুমায়ুন আজাদের কথা নিশ্চয়ই ভোলেননি কেউ। বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন একের পর এক হুমায়ুন আজাদের মতো হুমকি দিয়েছিল অভিজিৎ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালকেও। এই হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ ও জাফর ইকবালরা কিন্তু রাজপথের সৈনিক নয়। তারা মেধা নিয়ে কাজ করে। জাতি গঠনে তাদের অনেক বড় অবদান। তাই জাতিকে মেধাশূন্য করতে একটি গোষ্ঠী জাতি গড়ার কারিগরদের খুন করার পথ বেছে নিয়েছে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মুক্তচিন্তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাচ্ছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল সরাসরি আমার ছাত্র ছিলেন। তার স্ত্রী ইয়াসমিন হকও আমার ছাত্রী। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তাকে আমিই উৎসাহ দিয়েছিলাম। তিনি যখন আমেরিকায় একটানা ১৮ বছর বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেন, সে সময়ের শেষদিকে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর আমার বন্ধু সদর উদ্দীন চৌধুরী একদিন বললেন- ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সের একজন শিক্ষক প্রয়োজন, আপনার পরিচিত কেউ আছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার এক ছাত্র আছেন, তিনি এখন আমেরিকায়, খুবই মেধাবী। তার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি আসবেন কি-না।’ এরপর আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ই-মেইল করে সব জানালাম। তিনি আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি দেশে ফিরে আসতে চাই। এখানে অনেক সুযোগ। তবু আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই।’
ঠিকই তিনি দেশে ফিরে এলেন। তারপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। ভাইস চ্যান্সেলরকে বলে আমি বিষয়টার নামও পরিবর্তন করেছিলাম। শুরুতে বিষয়ের নাম ছিল কম্পিউটার সায়েন্স। বললাম, এই নাম থাকলে ছাত্র কম পাবে। পরে নাম দিলাম কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স। জাফর ইকবাল শুরু করলেন অধ্যাপনা। দিনের পর দিন আমার সেই মেধাবী ছাত্র তার বিভাগে সফলতা দেখিয়ে এলেন, দেশের তরুণদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক; তার উদার মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন কলাম দেশের সবক’টি বড় পত্রিকা একই দিনে যত্ন করে ছাপে। তার কলামের লাখ লাখ পাঠক, আমি আনন্দিত হয়ে লক্ষ্য করি, আমার এক ছাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। তিনি মুক্তচিন্তার পক্ষে যুক্তিপূর্ণ কথা বলেন, লেখেন; তার লেখায় ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই, তারপরও যুক্তি ও মুক্তচিন্তাই যেহেতু অন্ধকারের ঘাতকদের সবচেয়ে বড় শত্রু; তাই মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কোপানো হয়; তার প্রাণ বিপন্ন হয়।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর যে হামলা হলো সেই হামলার ভয় এই বয়সে এসেও আমাকে তাড়া করে। একবার হুমকি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন দিয়ে বিশেষ নিরাপত্তার জন্য লোকবল দিলেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিরাপত্তায়ও লোকবল ছিল। কিন্তু সেই নিরাপত্তায় যারা থাকেন, তাদের মধ্যে যদি দেশাত্মবোধ না থাকে, বাংলাদেশের মর্ম তার বুকের ভেতরে কাজ না করে; তবে কী হবে তাদের দিয়ে? আমরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল; অথচ তাদের ভেতরই যদি ঘাতক লুকিয়ে থাকে বা ঢুকে পড়ে; তবে তো খোদ প্রধানমন্ত্রীও নিরাপদ নন। নিরাপদ নন রাষ্ট্রপতিও।
আমার পুত্র অভিজিৎ হত্যার বিচার আমি চাই। গত দুই বছর গোয়েন্দা বিভাগে দৌড়াদৌড়ি করে যোগফল যখন শূন্য দেখছিলাম, ঠিক তখনই কিছুটা আশ্বস্ত হই। অভিজিৎ বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় তার তদন্তে এফবিআই এসেছিল। তারা তাদের কাজ শেষ করে রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে গেছেন। কিছুদিন আগে এই মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, তারা তিনজনকে গ্রেফতার করেছেন। এখন আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছেন। যিনি মূল হোতা। তাকে যত শিগগির ধরা যায় তত জলদি এই মামলার চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে। আর যদি না-ও ধরা যায় তবে ছয় মাসের বেশি তারা অপেক্ষা করবেন না। এই মূল হোতা সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত এক মেজর। নাম মেজর সৈয়দ জিয়া। অথচ এই জিয়াদের ওপর আমরা নির্ভরশীল। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন মঞ্চে ছিলেন তখন পুলিশও ছিল। কী করে ঘাতক মঞ্চে উঠে নিঃশব্দে তার পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে! সাধারণ পুলিশ যারা সেখানে ছিল; তারাও তো তাকে বাধা দিতে পারত।
বিচার করার দায়িত্ব সরকারের; একই সঙ্গে জেগে উঠতে হবে দেশের মানুষকে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটি আমরা পেয়েছি এই দেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে, প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ চিন্তা ও মত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারবে- এটুকু নূ্যনতম চাওয়া যদি না পূরণ হয়; তবে পাকিস্তান ভাঙল কেন? সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের কালো গহ্বর থেকে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছি প্রতিটি মানুষের ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এ জন্য স্কুল থেকে শিক্ষা পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তা চর্চার অবারিত সুযোগ তৈরির আহ্বান জানাই আমি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ভরসার স্থান, তাকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তৈরির এই মহাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রতিটি পরিবারে অসাম্প্রদায়িকতা চর্চার জন্য আমি গণমাধ্যম, বিশেষত পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজনের আহ্বান জানাই। আমাদের সময় কম, আমাদের এখনই জাগতে হবে। নইলে ঘন অন্ধকার আরও দ্রুত ধেয়ে আসবে।
সে যাক, আমি সবসময় একজন আশাবাদী মানুষ। আশা করি, অভিজিৎসহ সকল লেখক-বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হবে। বিচার হবে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা অপরাধের। একই সঙ্গে চাইব- আমার প্রিয় ছাত্র, বাংলাদেশের উজ্জ্বল মুখ মুহম্মদ জাফর ইকবাল খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে জীবনে ফিরে আসবেন নির্ভীক চিত্তে; যেমন তাকে সবসময় এই দেশ পেয়েছে, আমরা পেয়েছি।